“নিত্যনতুন আবিষ্কারে চমকে দেবো বিশ্বটারে, আমরা হবো বিশ্বমাঝে শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক”
এ শ্লোগান টির আলোকে ফুলকুঁড়ি বিজ্ঞান চক্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় ঢাকার মতিঝিল কেন্দ্রিক কিছু মেধাবী কিশোরের বিজ্ঞান ক্লাসের মাধ্যমে। যাদের মধ্যে ছিল খলদুন, আল-আমিন ও সোহেল প্রমুখ। তারা ১৯৭৯ সালে শিশু একাডেমিতে আয়োজিত আন্তর্জাতিক শিশু মেলায় বিজ্ঞান প্রজেক্ট নিয়ে অংশগ্রহণ করে। সেখানে তাদের প্রজেক্ট সাফল্যের সাথে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করে ।এরপর উদ্যম আর স্পৃহা বেড়ে গেল কয়েকগুণ।
১৯৮০ সালের মে মাসে দক্ষ সংগঠক হোসেনুজ্জামান আল আমিনের নেতৃত্বে সেসব কিশোর বিজ্ঞানীদের নিয়ে সংঘটিত হয় ফুলকুঁড়ি বিজ্ঞানচক্র। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের প্রতি শুক্রবার বিজ্ঞান ক্লাসেই বিজ্ঞান বিষয়ক আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর এর মাধ্যমে বিজ্ঞান চর্চা চলতো।এ প্লাস গুলোর গাইড হিসেবে সম্পৃক্ত ছিলেন বুয়েটের শিক্ষক ডঃ এনামুল হক, ডঃ ফজলে রাব্বি,ডঃ ফখরুল ইসলাম এবং টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞ নুরুল ইসলাম। এবছর সীমিত পরিসরে একটি বিজ্ঞান মেলার আয়োজনও করা হয়।
১৯৮২ সালে প্রথমবার জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় ক্লাবের নামে প্রজেক্ট নিয়ে অংশগ্রহণ করে বিজ্ঞানচক্রের সদস্য বৃন্দ। বিজ্ঞানচর্চা, প্রজেক্ট তৈরি ও খুদে বিজ্ঞানীদের সংগঠিত করাই ফুলকুঁড়ি বিজ্ঞানচক্রের কাজ হিসেবে নির্ধারিত হয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে জাতীয় বিজ্ঞান, তথ্য ও প্রযুক্তি মেলা এবং জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ করে বিজ্ঞানচক্রের সদস্য বৃন্দ। আর ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন বিজ্ঞান মেলায় পুরস্কৃত হয়েছে নিজেদের কাজের মাধ্যমে।
এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন হল- ১৯৮৪ সালে শিশু একাডেমী কর্তৃক আয়োজিত শিশু আনন্দ মেলায় ফুলকুঁড়ি বিজ্ঞানচক্র স্টল প্রদর্শনীতে প্রথম স্থান লাভ করে এবং ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান সহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার লাভ করে। ১৯৯১ সালে শিশু একাডেমী কর্তৃক আয়োজিত বিজ্ঞান মেলার প্রজেক্ট প্রদর্শনীতে পুরস্কার লাভ করে। ১৯৯৩ সালে শিশু আনন্দ মেলায় বিজ্ঞান প্রজেক্টে প্রথম স্থান অধিকার করে। ১৯৯৫ সালে বিজ্ঞান মেলায় জাতীয়ভাবে প্রথম, তৃতীয় ও পঞ্চম স্থান সহ কয়েকটি পুরস্কার লাভ করে। ২০০৪ সালে জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ করে প্রথম স্থান সহ বেশ কয়েকটি পুরস্কার লাভ করে । এছাড়া বিসিএসআইআর কর্তৃক আয়োজিত জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় ধারাবাহিকভাবে আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছে বিজ্ঞান চক্রের সদস্যবৃন্দ।
দারাভাহিক বিজ্ঞান চর্চার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের ’ক’ শ্রেণির রেজিস্ট্রেশন লাভ করে ফুলকুঁড়ি বিজ্ঞানচক্র। এছাড়া সারাদেশে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা ক্লাব রয়েছে। শিশু-কিশোর ক্ষুদে বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহিত করার জন্য ফুলকুঁড়ি বিজ্ঞানচক্র নিয়মিত জাতীয় বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করে থাকে। খুদে বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত শতাধিক বিজ্ঞান প্রজেক্ট নিয়ে ২০০৮ সালে বাংলাদেশে পাবলিক লাইব্রেরি চত্বরে আয়োজিত হয় জাতীয় বিজ্ঞান মেলা। ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমী চত্বরে বিপুল আয়োজনে তিন দিনব্যাপী জাতীয় বিজ্ঞানমেলা এবং বিজ্ঞান বক্তৃতার আয়োজন করা হয়। মেলা উদ্বোধন করেছিলেন বুয়েট অধ্যাপক ড. কায়কোবাদ এবং বিজ্ঞান সেমিনারের প্রধান বক্তা ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ডঃ জামাল নজরুল ইসলাম।
মেলায় ৫০ টিরও বেশি ক্লাব থেকে প্রায় দুইশত প্রজেক্ট অংশগ্রহণ করে। ২০১২ সালে শিশু কল্যাণ পরিষদে আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় শতাধিক প্রজেক্ট অংশ নেয়।মেলাটি উদ্বোধন করেছিলেন জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর এর পরিচালক মোঃ সাইদুর রহমান । ২০১৪ সালে একই স্থানে আয়োজিত বিজ্ঞান মেলায় আকর্ষণীয় কিছু প্রজেক্ট অংশগ্রহণ করে। প্রথম স্থান অধিকারী প্রজেক্ট ছিল অভিযাত্রী বিজ্ঞান চক্রের সদস্য নাজমুস সাকিব উদ্ভাবিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য “স্মার্ট- কন্ট্রোল গ্লাস”। পরবর্তীতে এই প্রজেক্ট সৌদি বাদশাহ প্রিন্স আব্দুল আজিজ কিশোর উদ্যোক্তা পুরস্কার ২০১৫ সালে প্রথম স্থান লাভ করে।
দীর্ঘ প্রায় তিন যুগের পথ চলায় বিজ্ঞান চক্রের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে অনেক শিশু কিশোর, সংগঠন এবং শুভানুধ্যায়ী। ফুলকুঁড়ি বিজ্ঞান চক্রের সদস্যদের অনেকেই এখন নিজস্ব অংগনে প্রতিষ্ঠিত। তাদের মধ্যে ঢাকার ডাক্তার আবিদ জাফর, ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন,রংপুরের আশফাকুল মাওলা প্রোটন, কুমিল্লার কৃষিবিজ্ঞানী গোলাম আলী সুমন, বগুড়ার রাশেদ রুকন অন্যতম। আবার কেউ আমাদের আঙিনা থেকে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার বখতিয়ার হোসেন পবন এবং কক্সবাজারের মেহেদির কথা স্মরণ করতেই হয়। পবন ছিল বিজ্ঞান শব্দের নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক। দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন রোড এক্সিডেন্টে তার আকস্মিক মৃত্যু হয়। সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র মেহেদির বিজ্ঞান প্রতিভা ছিল অবিস্মরণীয়। ২০০৮ সালে জাতীয় বিজ্ঞান মেলায় তার উদ্ভাবিত প্রজেক্ট বিচারকদের দৃষ্টি এতটাই কেড়েছিল যে তারা জাতীয় বিজ্ঞান জাদুঘরে সে প্রজেক্টে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। ২০১০ সালে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে সে মৃত্যুবরণ করেন। আমরা তাদের পরকালীন শান্তি কামনা করছি। পরিশেষে বলতে হয়, শিশু-কিশোরদের বিজ্ঞান চর্চায় উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে একটি বিজ্ঞানমনস্ক জাতিগঠনের প্রক্রিয়ায় ফুলকুঁড়ি বিজ্ঞানচক্রের কার্যক্রম একটি অনন্য ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি এবং বিজ্ঞানীদের অভাবনীয় উন্নতির এ যুগে এর কার্যক্রমকে আরও শাণিত, সম্প্রসারিত ও যুগোপযোগী করা দরকার।
বিজ্ঞান অনুরাগী শিশু–কিশোরদের বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহ উদ্ভাবনমূলক চিন্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফুলকুঁড়ি বিজ্ঞান চক্র পাঁচটি বিভাগীয় কর্মসূচি পালন করে।
১. প্রশিক্ষণ বিভাগ: এ বিভাগের অধীনে বিজ্ঞানক্লাস, আলোচনা সভা, এস কম্পিউটার শিখি, বিজ্ঞান সেমিনার, বিজ্ঞান ভ্রমণ, ক্ষুদে বিজ্ঞানী সম্মেলন ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়।
২. প্রজেক্ট বিভাগ: প্রজেক্ট উদ্ভাবনে শিশু-কিশোরদেরকে উৎসাহ ও সহায়তা প্রদান এবং বিজ্ঞান গড়ে তোলা ও সমৃদ্ধ করা এবং উদ্ভাবিত প্রজেক্টগুলো মানোন্নয়ন এ বিভাগের কাজ।
৩. পাঠাগার: বিজ্ঞান বিষয়ক বই, সাময়িকী সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা, জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ ও বিজ্ঞান কুইজ প্রতিযোগিতা করা এ বিভাগের কাজের অংশ।
৪. প্রকাশনা বিভাগ: দেয়ালিকা, বিজ্ঞান সাময়িকী, বিজ্ঞানীদের জীবনী, সাইন্স ফিকশন, দেশি বিদেশী সিডি,বিজ্ঞান বিষয়ক মুভি ও শিশু উপযোগী বিভিন্ন প্রকাশনা প্রকাশ করা এ বিভাগের কাজ।
৫. প্রদর্শনী বিভাগ: উদ্ভাবিত পদ সমূহ প্রদর্শন করা বিশেষ করে স্থানীয়/ জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সপ্তাহে প্রজেক্ট প্রদর্শন করা এবং স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করা এ বিভাগের কাজ বলে বিবেচিত হবে।